Home ইসলাম ও জীবন আত্মশুদ্ধির বাসনায় পবিত্র হজ পালন

আত্মশুদ্ধির বাসনায় পবিত্র হজ পালন

পাপমুক্তি আর আত্মশুদ্ধির আকুল বাসনায় পবিত্র মক্কা নগরীর অদূরে ‘উকুফে আরাফা’ অবস্থানের মধ্যদিয়ে গতকাল পবিত্র হজ পালন করেছেন গোটা দুনিয়া থেকে আগত লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমান। আরাফাতের পাহাড় ঘেরা ময়দান ছাপিয়ে আকাশ-বাতাস মুখর ও প্রকম্পিত হতে থাকে আবেগাপ্লুত বেশুমার কণ্ঠের ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লা-শারিকালাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়ান্ নে’মাতা লাকা ওয়াল মুলক লাশারিকা লাক’-তালবিয়ায়। ‘জাবালে রহমত’ সাদা আর সাদায় একাকার। সবার পরনে সাদা দুই খণ্ড বস্ত্র। সবারই দীন-হীন বেশ। নেই আশরাফ-আতরাফ     বিভেদের অচলায়তন। দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ, রহমতপ্রাপ্তি ও নিজের গুণাহ মাফের জন্য আল্লাহতায়ালার মহান দরবারে অশ্রুসিক্ত ফরিয়াদ জানান সমবেত মুসলমানেরা। একে অপরের সাথে পরিচিত হন, কুশল বিনিময় করেন। বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের এক অনুপম দৃশ্যেরও অবতারণা হয় গতকাল সেই ময়দানে। বিশ্ব মুসলমানের মহাসম্মিলনের দিন।

গতকাল দুপুরে সূর্য পশ্চিমাকাশে হেলে পড়ার পর মসজিদে নামিরা থেকে খুতবা প্রদান করেন সৌদি আরবের মুফতি। হজের খুতবা শুনে ইমামের পিছনে পরপর জোহর ও আসরের নামাজ জোহরের ওয়াক্তে আদায়ের পর সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করেন হাজিরা। বাংলাদেশ থেকে সৌদি আরবের সময় ব্যবধান তিনঘণ্টা। সূর্যাস্তের পর আরাফাতের ময়দান ত্যাগ করে মুযদালিফার উদ্দেশে রওয়ানা হন হাজিরা। মূলত ৯ জিলহজ আরাফাতের ময়দানের দিনকেই হজের দিন বলা হয়।

খুতবায় মুফতি মুসলিমদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহবান জানান। মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে বড় সমাবেশ এবারের হজে ২০ লাখের বেশি মুসলমান অংশ নিচ্ছেন। আল্লাহ রাবু্বল আলামিনের মেহমানরা গতকাল সূর্যোদয়ের পর মিনা থেকে কেউ গাড়িতে, কেউ পায়ে হেঁটে আরাফাতের ময়দানের দিকে রওনা হন। সৌদি কর্তৃপক্ষ হাজিদের আরাফাত ময়দানে আনার জন্য বিপুলসংখ্যক গাড়ির ব্যবস্থা করেন। ইহরাম পরা মুসলিমদের এই স্রোত যতই আরাফাতের নিকটবর্তী হতে থাকে, ততই তারা ভাবাবেগে উদ্বেলিত হয়ে ওঠেন। তাদের মানস চোখে ভেসে ওঠে সেই আরাফাত ময়দানের ছবি, যেখানে ১৪০০ বছর আগে আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিদায় ভাষণ দিয়েছিলেন। এই ময়দানে মহান আল্লাহতায়ালা তার প্রিয় নবীর কাছে সর্বশেষ ওহি নাজিল করেছিলেন, ‘আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে (ইসলাম) পরিপূর্ণ করলাম, তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন মনোনীত করলাম।’ (সূরা আল মায়িদা, আয়াত-৩) । বিদায় হজ থেকে ফেরার তিন মাসের মাথায় ইসলামের কাণ্ডারি রাহমাতুল্লিল আলামিন প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম ইন্তেকাল করেন।

আরাফাতের ময়দান সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২৫০ মিটার উঁচুতে। চারপাশে পাহাড়ঘেরা একটি সমতল ভূমি। হাজিদের কেউ কেউ সেখানে তাঁবু টানিয়ে, কেউবা খোলা আকাশের নিচে মাথায় ছাতা ধরে অবস্থান করেন। অনেকে আগের রাতেই সোজা উঠে যান আরাফাত ময়দানসংলগ্ন ৭০ মিটার উঁচু ‘জাবালে রহমত’ তথা রহমতের পাহাড়ে। রহমতের পাহাড়ে উঠে সেখানেই তাঁরা দিনভর মহান আল্লাহর করুণা ও মাগফিরাত কামনা করেন। বিশ্বের সর্ববৃহত্ মসজিদ ‘মসজিদে নামিরাহ’ থেকে জোহরের নামাজের আগে বয়ান ও খুতবা পাঠ করেন সৌদি আরবের মুফতি। এই মসজিদকে একদিনের মসজিদ বলা হয়।

আরাফাত ময়দানে অবস্থান করা হজের অন্যতম ‘ফরজ’ বা অবশ্য পালনীয়। আরাফাতের পাহাড়ে একটি বড় উঁচু পিলার আছে। একে কেউ কেউ দোয়ার পাহাড়ও বলে থাকেন। উঁচু পিলারের কাছে যাওয়ার জন্য পাহাড়ে সিঁড়ি করা আছে, যাতে এটি বেয়ে খুব সহজে চূড়ায় চলে যাওয়া যায়। জনশ্রুতি আছে যে, হযরত আদম (আ.) ও বিবি হাওয়া (আ.) দীর্ঘদিন কান্নাকাটির পর এখানেই এসে মিলিত হয়েছিলেন। হাজিরা আরাফাত ময়দানে অবস্থান শেষে তাদের গন্তব্য মুযদালিফা।

মুযদালিফায় গিয়ে মাগরিব ও এশা’র নামাজ এশা’র ওয়াক্তে একত্রে পড়বেন এবং সমস্ত রাত অবস্থান করবেন। মিনায় জামরাতে নিক্ষেপ করার জন্য ৭০টি কংকর এখান থেকে সংগ্রহ করবেন। মুযদালিফায় ফজরের নামায পড়ে মিনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবেন। ১০ জিলহজ মিনায় পৌঁছার পর হাজিদের পর্যায়ক্রমে চারটি কাজ সম্পন্ন করতে হয়। প্রথমে মিনাকে ডানদিকে রেখে হাজিরা দাঁড়িয়ে শয়তানকে (জামারা) পাথর নিক্ষেপ করবেন। দ্বিতীয় কাজ আল্ল­­াহর উদ্দেশ্যে পশু কোরবানি করা। অনেকেই মিনায় না পারলে মক্কায় ফিরে গিয়ে পশু কোরবানি দেন। তৃতীয় পর্বে মাথা ন্যাড়া করা। চতুর্থ কাজ তাওয়াফে জিয়ারত। হাজিরা মক্কায় ফিরে কাবা শরীফ ‘তাওয়াফ’ ও ‘সাঈ’ (কাবার চারদিকে সাতবার ঘোরা ও সাফা-মারওয়া পাহাড়ে সাতবার দৌড়ানো) করে আবার মিনায় ফিরে যাবেন।

জিলহজের ১১ তারিখ মিনায় রাত যাপন করে দুপুরের পর থেকে সূর্যাস্তের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত সময়ের মধ্যে হাজিরা বড়, মধ্যম ও ছোট শয়তানের উপর সাতটি করে পাথর নিক্ষেপ করবেন। আর এ কাজটি করা সুন্নত। পরদিন ১২ জিলহজ মিনায় অবস্থান করে পুনরায় একইভাবে হাজিরা তিনটি শয়তানের উপর পাথর নিক্ষেপ করবেন। শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ করা শেষ হলে অনেকে সূর্যাস্তের আগেই মিনা ছেড়ে মক্কায় চলে যান। আর মক্কায় পৌঁছার পর হাজিদের একটি কাজ অবশিষ্ট থাকে। সেটি হচ্ছে কাবা শরীফ তাওয়াফ করা। একে বলে বিদায়ী তাওয়াফ। স্থানীয়রা ছাড়া বিদায়ী তাওয়াফ অর্থাত্ কাবা শরীফে পুনরায় সাতবার চক্কর দেয়ার মাধ্যমে হাজিরা সম্পন্ন করবেন পবিত্র হজব্রত পালন।

হজের খুতবায় মুসলিম উম্মাহকে

ঐক্যবদ্ধ হওয়ার তাগিদ

আরাফাতের ময়দানে পবিত্র হজের খুতবায় খতিব শায়খ ড. সাআদ বিন নাসের আশ শিছরি মুসলিম উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার তাগিদ দিয়ে বলেছেন, আপনারা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হওয়া যাবে না। ঐক্য অটুট রাখতে হবে। বিচ্ছিন্ন থাকলে ইসলামের দুশমনরা সুযোগ পায়। তিনি বলেন, আল্লাহ সব ক্ষেত্রে নিরাপত্তা বিধানের নির্দেশ করেছেন। প্রত্যেকের নিরাপত্তা বিধান করা ইসলামের নির্দেশ। অশান্তি সৃষ্টি করা যাবে না, অশান্তিমূলক কোনো কাজ করা যাবে না, এটা ইসলামে নিষিদ্ধ। তিনি বলেন, যারা আল্লাহর পথ ধরবেন আল্লাহ তাদেরকে শান্তিতে রাখবেন।

খতিব মুসলিম উম্মাহর সবচেয়ে বড় এই সম্মেলনে ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান কামনা করেন। ফিলিস্তিনে যেন শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং পবিত্র মসজিদুল আকসা যেন আবার মুসলমানদের অধিকারে আসে সেই প্রত্যাশা  জানান।

সৌদি আরবের সর্বোচ্চ ওলামা পরিষদের সদস্য, বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ আল সৌদের রাজকীয় উপদেষ্টা শায়খ ড. সাআদ বিন নাসের এ বছর নতুন খতিব হিসাবে আরাফার ময়দানে মসজিদে নামিরায় এই খুতবা দেন। স্থানীয় সময় দুপুর ১২টা ২৫ মিনিটে (বাংলাদেশ সময় ৩টা ২৫) খুতবা শুরু হয়। চলে প্রায় ২৫ মিনিট।

খুতবার পর মসজিদে নামিরায় একসঙ্গে জোহর ও আসরের নামাজ আদায় করেন হাজিরা। সূর্যাস্থ পর্যন্ত এখানে অবস্থানের পর রাতে হাজিরা যান মুজদালিফায়। হজের খুতবায় খতিব তাওহিদ বা আল্লাহর একত্ববাদের প্রতি গুরুত্বারোপ করেন। একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করতে বলেন। আল্লাহ, ফেরেশতা, কিতাব, আখেরাত এসবের প্রতি ঈমান সুদৃঢ় করার প্রতি তাগিদ দেন খতিব।

খতিব বলেন, শরিয়তের সৌন্দর্য হলো মানুষের প্রতি অনুগ্রহ ও জীবনের সবক্ষেত্রে ন্যায় ও সমতা প্রতিষ্ঠা করা। তিনি বলেন, ‘যারা ইমান এনেছে, সত্কর্ম করেছে, তাদেরকে আল্লাহ সাহায্য করবেন। ভয় ভীতি দূর করে দেবেন। খতিব মুসলিমদেরকে আল্লাহর নির্ধারিত সীমা লংঘন না করার তাগিদ দেন। কোনো চুক্তি করলে তা রক্ষা করার কথা বলেন।

শায়খ ড. সাআদ বিন আন নসর আশ শাসরি বলেন, মানুষের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ নেই। আল্লাহ কৃত্রিম ভেদাভেদ না করতে বলেছেন। তিনি পবিত্র হজের সময় হারাম শরিফে এসে কোনো অনাকাঙ্খিত কর্মকাণ্ড না করতে আহ্বান জানান। এখানে এসে দলাদলি না করার ব্যাপারে সাবধান করেন।

খতিব বলেন, আল্লাহর রাসুল সা. আমাদের জন্য দুটি জিনিস রেখে গেছেন, সেই দুটি জিনিস হলো কোরআনে কারিম ও আল্লাহর রাসুলের সুন্নত। প্রতিটি মুসলমানের উচিত এই দুটি জিনিসকে আঁকড়ে ধরা।

তিনি বলেন, কোরআন জীবনের সব ক্ষেত্রের জন্য। এজন্য কোরআনকে আঁকড়ে ধরতে হবে। কোরআন পড়তে হবে, সেই অনুযায়ী চলতে হবে। পরিশেষে খতিব সৌদি বাদশা, হারামাইনের যার খেদমত করছেন এবং সমগ্র মুসলিম উম্মাহর জন্য দোয়া করেন। [সুত্রঃ ইত্তেফাক]