হাজার হাজার বছর আগে এই দিনে তথা ১৮ জিলহজ হযরত ইব্রাহিম (আ)-কে এক বিশাল অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করা হলে তা মহান আল্লাহর কুদরতে একটি নাতিশীতোষ্ণ ফুল-বাগানে পরিণত হয়।
খোদাদ্রোহী জালিম রাজা নমরুদের নির্দেশে মহান আল্লাহর রাসুল হযরত ইব্রাহিম (আ)-কে ওই অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। এক আল্লাহর ইবাদত তথা একত্ববাদের প্রচার ও মূর্তিপূজার বিরোধিতার কারণেই তাঁকে আগুনে পুড়িয়ে মারতে চেয়েছিল নমরুদ ও তার দলবল বা সহযোগীরা। কিন্তু তিনি অক্ষত অবস্থায় সেখান থেকে বেরিয়ে অাসেন। এই অলৌকিক ঘটনার পর বহু মানুষ দলে দলে একত্ববাদের প্রতি ইমান আনে। অন্যদিকে নমরুদ ও তার দলবল এই ঘটনাকে জাদু বলে প্রচার করে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা অব্যাহত রাখে।
বলা হয় অগ্নিকুণ্ডটি ফুল-বাগানে পরিণত হয়েছে-এটা দেখতে পেরে নমরুদের এক সহযোগী কর্মকর্তা দাবি করেছিল যে তার নির্দেশের কারণেই আগুন ইব্রাহিমকে স্পর্শ করেনি। তার ওই দাবির সঙ্গে সঙ্গে আগুন এসে খোদ ওই কর্মকর্তাকেই জ্বালিয়ে দেয়।
আজকের এই ঐতিহাসিক দিনেই মহান আল্লাহর আরেক রাসুল হযরত মুসা (আ) মহান আল্লাহর নির্দেশে ইউশা বিন নুনকে নিজের উত্তরাধিকারী বা খলিফা বলে ঘোষণা করেন। বহু শতক পর এ দিনেই হযরত সুলাইমান (আ) আল্লাহর নির্দেশে আসিফ বিন বারখিয়াকে নিজের প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ দেন। বহু বছর পর একই দিবসে হযরত ঈসা (আ) শামউন বা শিমনকে তথা ইয়াকুব নবীর (আ) দ্বিতীয় পুত্রকে নিজের খলিফা বা প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ দেন।
আর বহু শতক পর এ দিনেই বিদায় হজের কয়েক দিন পর বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) মহান আল্লাহর নির্দেশে আমিরুল মু’মিনিন হযরত আলী (আ) নিজের খলিফা বা প্রতিনিধি বলে ঘোষণা করেছিলেন। দিনটি ছিল ৬৩২ খ্রিস্টাব্দ বা দশম হিজরির ১৮ জিলহজ।
বিদায় হজের পর রাসূলুল্লাহ (সা.) মদিনায় ফেরার পথে গাদির-এ-খুম নামক স্থানে আল্লাহর নির্দেশে এক অভিষেক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে হজরত আলীকে (আ) মুমিনগণের মাওলা হিসেবে মনোনীত করেন। ওই ঐতিহাসিক ঘটনার ৮০ কিংবা ৮৪ দিন পর আল্লাহর রাসূল (সা.) আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে যান। প্রিয়নবী (সা.) জীবনে মাত্র একবার হজ পালন করেছিলেন।
বিদায় হজ সমাপনের পর তিনি মদিনা অভিমুখে যাত্রা করেছিলেন এহরাম পরা অবস্থায়। সঙ্গে সোয়া লাখ সাহাবি ছিল। পথে ১৮ জিলহজ মদিনার নিকটবর্তী গাদির-এ-খুম নামক স্থানে উপস্থিত হলে পবিত্র কুরআনের শেষ আয়াতের আগের আয়াত নাজিল হয়।
সুরা মায়েদার ওই আয়াতে মহান আল্লাহ এরশাদ করেছেন: “হে রসূল, পৌঁছে দিন আপনার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আপনার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে। আর যদি আপনি এরূপ না করেন, তবে আপনি তাঁর পয়গাম কিছুই পৌঁছালেন না। আল্লাহ আপনাকে মানুষের কাছ থেকে রক্ষা করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ কাফেরদেরকে পথ দেখান না।” (সুরা মায়েদার ৬৭ নম্বর আয়াত)
আল্লাহর পক্ষ থেকে এই নির্দেশ নাজিল হওয়ার পর, রাসূলুল্লাহ (সা.) গাদির-এ-খুম নামক স্থানে আল্লাহর ওই ঘোষণাটি উম্মতকে জানিয়ে দেয়ার জন্য এক অভিষেক অনুষ্ঠানের আয়োজন করলেন। বারায়া ইবনে আজেব ও জায়েদ ইবনে আকরাম বর্ণনা করেন, ‘যখন রাসূলুল্লাহ (সা.) গাদির-এ-খুম নামক এলাকায় এসে থামলেন, তখন সবাইকে একত্রিত করলেন, হজরত আলীর (আ) হাত ধরে উপরে তুললেন এবং জনতার উদ্দেশে বললেন, ‘তোমরা কি জান, আমি মুমিনদের নিজেদের প্রাণের চেয়েও বেশি আওলা (প্রিয়)?’ লোকেরা বললেন, ‘হ্যাঁ ইয়া রাসূলুল্লাহ (সা.)’। অতঃপর তিনি বললেন, ‘মান কুনতুম মাওলাহু ফাহাজা আলীয়্যুন মাওলাহু, আল্লাহুম্মা ওয়ালে মান ওয়াল্লাহু, আদা মান আদাহু, আনসুর মান নাসারা, আখজুল মান খাজালা, ফালা ইয়াস হাদিল হাজেরুল খায়রা।’অর্থাৎ হে আল্লাহ, আমি যার মাওলা এই আলীও তার মাওলা। হে আল্লাহ যে তাকে বন্ধু বানায় তুমিও তাকে বন্ধুরূপে গ্রহণ কর, আর যে তার সঙ্গে শত্রু তা করে তুমিও তাকে শত্রু হিসেবে গ্রহণ কর।
অতঃপর প্রভাবশালী সাহাবি ওমর ইবনে খাত্তাব হজরত আলীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে অভিনন্দন জানিয়ে বললেন, ‘ওহে আবু তালেবের সন্তান, প্রত্যেক মুমিন নর-নারীর মাওলা হিসেবে তুমি সকাল করবে, সন্ধ্যা করবে (বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ইবনে কাসির, ৭ম খণ্ড, পৃঃ ৬১৬, ইঃফাঃবা (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ)। এই হাদিসটি কমপক্ষে ১১০ জন সাহাবা, ৮৪ জন তাবেঈন, ২৫৫ জন ওলামা, ২৭ জন হাদিস সংগ্রাহক, ১৮ জন ধর্মতত্ত্ববিদ, ১১ জন ফিকাহবিদ, ইমাম ও ওলামা যেমন মুসনদে ইবনে হাম্বল, তিরমিযি, নাসাঈ, ইবনে মাযা, আবু দাউদ, তফসিরে কাশশাফ ইত্যাদি বিখ্যাত কিতাবে উল্লেখিত হয়েছে। শাহ ওয়ালীউল্লাহ মোহাদ্দেস দেহলবীর ‘ইজালাতুল খাফা’ কিতাবও বিশেষভাবে দ্রষ্টব্য।
পবিত্র কুরআনেও আল্লাহতায়ালা হজরত আলীকে (আ) মুমিনগণের মাওলা হিসেবে ঘোষণা করছেন। দেখুন পবিত্র কুরআনের আয়াত ‘অবশ্যই আল্লাহ তোমাদের মাওলা (অভিভাবক), তাঁর রাসূল (সা.) তোমাদের মাওলা এবং যে ঈমান এনেছে, নামাজ কায়েম করে এবং জাকাত প্রদান করে রুকুকালীন অবস্থায়’ (সুরা মায়েদা : ৫৫)। তফসিরকারকরা সবাই একমত যে, উক্ত আয়াত হজরত আলীর (আ)শানে নাজিল হয়েছে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহপাক আমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন, ‘ইয়া আইয়্যুহাল লাজিনা আমানু আতীউল্লাহ, ওয়া আতিউর রাসূলা ওয়া উলিল আমরি মিনকুম’(সূরা নিসা : ৫৯)। অর্থ হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লাহকে মান এবং রাসূলকে (সা.) মান এবং উলিল আমরকে মান। ‘উলিল আমর’ অর্থ এখানে আল্লাহ এবং রাসূল (সা.)-এর পক্ষ থেকে উম্মতকে পরিচালনা বা হুকুম প্রদানে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিনিধি। আল্লাহ এবং রাসূল (সা.)-এর নির্দেশ মানা সব মুমিন নর-নারীর জন্য ফরজ।
আল্লাহর নির্দেশে রাসূল (সা.) গাদির-এ-খুম এলাকায় হজরত আলীকে(আ) ‘অসি’ (নিজের অনুপস্থিতিতে বা অবর্তমানে আপন কাজ সমাধা করার জন্য প্রতিনিধি নিযুক্তি), পবিত্র কৃরআনের ভাষায় উম্মতের ‘উলিল আমর’ বা ‘মাওলা’রূপে নিযুক্তি দিয়ে যান। ইমাম ওয়াকেদি তার আসবাউল নজুল কিতাবে, আবু সাঈদ খুদরি (রা.)-এর বর্ণনায়, হাফিজ আবু রাফে (রা.)-এর বরাতে ইমাম ইব্রাহিম বিন মুহাম্মদ আল হামাউয়াইনিশ শাফেয়ী তার ফারিদুস সামাতাঈন কিতাবে আবু হুরাইরার বর্ণনায় বলেন সূরা মায়েদার উল্লেখিত ৬৭নং আয়াতটি হজরত আলী (আ)-এর শানে অবতীর্ণ হয়।
এভাবে হজরত আলীর (আ) প্রতিনিধিত্ব বা মওলাইয়্যাতের বায়াত শেষ হলে পবিত্র কুরআনের শেষ আয়াতটি নাজিল হল (দেখুন বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ইবনে কাসির, ৭ম খণ্ড, পৃঃ ৬১৬, ৬১৭, ইঃফাঃবা)। ‘আজ কাফেররা তোমাদের দ্বীন থেকে নিরাশ হয়ে গেল, অতএব তাদের ভয় কর না। ভয় কর আমাকে আজ তোমাদের দ্বীন পূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের দ্বীনের ওপর আমি রাজি হয়ে গেলাম ’ ( সূরা মায়েদা : ৩)। উম্মতে মুহাম্মদীর দ্বীন পরিপূর্ণ হওয়ার ঘোষণা এবং তাদের ওপর আল্লাহর নেয়ামত দান করার বিষয়টি সম্পূর্ণ হল। তাই প্রিয়নবী (সা.) আল্লাহর দরবারে এ বলে প্রার্থনা করলেন ‘আল্লাহু আকবর আল হামদুলিল্লাহে আলা আকমালে দ্বীনা, ওয়া এতমামেন নেয়ামতি ওয়া রাজা-এ-রাব্বি আলা রেসালাতি ওয়া বেলায়াতি আলী ইবনে আবি তালিব।’অর্থ আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব দ্বীনকে কামেল করে দেয়ার ওপর এবং নেয়ামতকে পরিপূর্ণ করে দেয়ার ওপর এবং আবু তালেব নন্দন আলীর বেলায়তের জন্য সব প্রশংসা আল্লাহর।
প্রিয়নবী (সা.) একদিন মসজিদে নব্বীতে সবার উদ্দেশে বললেন, ‘ইন্নি খাজা সিরাতিম মুস্তাকিম’। অর্থ নিশ্চয়ই এই হচ্ছে তোমাদের জন্য সিরাতুল মুস্তাকিম। সাহাবার বললেন, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ (সা.) ইনি কে’? প্রিয়নবী (সা.) বললেন ‘একটু অপেক্ষা কর’। এ সময় হজরত আলী (আ) রাসূল (সা.)-এর খেদমতে হাজির হলেন। প্রিয়নবী (সা.) আলীর কপালে চুমু খেয়ে লোকদের উদ্দেশে বললেন ‘ইন্না হাজা সিরাতি ’ অর্থাৎ নিশ্চয়ই সে আমার সিরাত বা পথ নির্দেশক। (সূত্র : দুররে মনসুর, আল্লামা সিয়ুতি)।
মেশকাত শরিফে উল্লেখ রয়েছে রাসূলুল্লাহ (সা.) সাহাবাদের উদ্দেশে বললেন, ‘যদি তোমরা আলীকে তোমাদের পথ নির্দেশক হিসেবে মেনে নাও তাহলে তোমরা তোমাদের সর্বাবস্থায় সিরাতুল মোস্তাকিমের মধ্যে শামিল পাবে। প্রিয়নবী (সা.) হজরত আলীর শানে আরও বলেন, আনা মদিনাতুল ইলম আলীউন বাবুহা। আমি জ্ঞানের নগর এবং আলী এই নগরের দরজা। বিশ্বনবী (সা) আরও বলেছেন, ‘আনা দারুল হিকমা ওয়া আলীয়্যুন বাবুহা’ অর্থ, আমি হলাম হিকমতের গৃহ আর আলী হলেন তার দুয়ার। আমার পর আলী সব মুমিনদের অভিভাবক।