শখের মোটর সাইকেল বা বাইক নিয়ে কতই না ভাবনা। বাসার বাইরে গিয়ে কোথাও রাখলে মনের মধ্যে চুরির ভয় কাজ করে। অতিরিক্ত তালা লাগিয়েও অনেক সময় চুরি ঠেকানো যায় না। প্রচলিত যে তালা (লক) রয়েছে তা ভেঙ্গে চুরি হচ্ছে হরহামেশাই। তাই মোটর সাইকেল নিয়ে মালিকদের দুঃশ্চিন্তার শেষ নেই। তবে এবার মোটর সাইকেল চুরি ঠেকাতে আবিষ্কৃত হয়েছে ‘এন্ট্রি থিপ সিস্টেম’ (এটিএস)।
তালা ভেঙ্গে মোটর সাইকেল চালুর লাইনে তার জুড়েও চালু করা সম্ভব নয়। ‘এটিএস’ এরই মধ্যে ব্যবহারকারীদের মাঝে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। বিস্ময়কর এই ডিভাইসটি আবিষ্কার করেছেন মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার মোহাম্মদপুর গ্রামের তরুণ বিজ্ঞানী সাহাব উদ্দীন। দীর্ঘ প্রায় ৮ বছর ঢাকার উত্তরা মোটর্সের অধীনে গবেষণার পর সম্প্রতি দেশজুড়ে বাজারজাত শুরু হয়েছে সাহাব উদ্দীনের ‘এটিএস’।
‘এটিএস’ ব্যবহার বিষয়ে সাহাবউদ্দীন বলেন, একটি ছোট ডিভাইস মোটর সাইকেলের গোপন স্থানে বসানো হয়। ‘আরএফআইটি’ কার্ডের সঙ্গে যুক্ত আরেকটি এন্টেনা ডিভাইস থাকে গাড়ির স্টার্ট লকের পাশে। চাবি রিংয়ের সঙ্গে যুক্ত প্রোগ্রামিং করা ডিভাইস। চাবি অন করে দু’টি ডিভাইস পাঞ্চ করে স্টার্ট করতে হয়। পাঞ্চ করা ছাড়া কোনো অবস্থায় মোটর সাইকেল স্টার্ট হবে না।
অপরদিকে অন্য কোনো ডিভাইস দিয়ে কেউ চেষ্টা করলেও বাইক স্টার্ট করতে পারবে না। বরং মোটর সাইকেলের হর্ন অনবরত বাঁজতে থাকবে। প্রতিটি ‘এটিএস’ কম্পিউটরে ভিন্ন ভিন্ন গোপন প্রোগ্রাম কোড দেয়া। তাই কোনোভাবেই একটি দিয়ে অন্যটি পাঞ্চ কিংবা অন হবে না। ফলে মোটর সাইকেল স্টার্ট করে চুরি করা একেবারেই সম্ভব নয়।
সাহাবউদ্দীন মোহাম্মদপুর গ্রামের রহমতুল্লাহর ছেলে। ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন যন্ত্রপাতির প্রতি ঝোঁক ছিলো। এটা-ওটা নাড়াচাড়া করাই ছিলো তার অন্যতম কাজ। ২০০৭-২০০৮ সালের দিকে বেকার তরুণ সাহাবউদ্দীন নিজ বাড়িতে বসে মোবাইল ডিভাইস দিয়ে মোটর সাইকেল চুরি প্রতিরোধী তালা আবিষ্কার করেন। আবিষ্কারের খবর স্থানীয় ও জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়।
এতে বাংলাদেশের স্বনামধন্য অটোমোবাইল কোম্পানি উত্তরা মোটর্সের চেয়ারম্যান মতিউর রহমানের নজরে পড়েন সাহাব উদ্দিন। তালা নিয়ে গবেষণার জন্য তিনি সাহাবউদ্দিনকে কাছে টেনে নেন। উত্তরা মোটর্সের তত্বাবধানে একজন গবেষক হিসেবে তখন থেকেই তিনি কাজ শুরু করেন।
গবেষণার পথচলায় মোটর সাইকেলসহ বিভিন্ন গাড়ির নিরাপত্তা ও উন্নত লাইট আবিষ্কার করে সফলতা অর্জন করেছেন। ফলশ্রুতিতে জাতীয় পর্যায়ের পদকও জুটেছে তার ভাগ্যে। পরপর ৩ বছর জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মেলায় দেশসেরা উদ্ভাবক হিসেবে পুরস্কার পেয়েছেন। এছাড়াও ব্যাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে ‘এটিএস’ এবং এসটিপি’র পেটেন্ট পেয়েছেন। এখন এর একমাত্র সত্ত্বাধিকারী সাহাবউদ্দীন।
উত্তরা মোটর্সের চেয়ারম্যান ও মিডিয়াকর্মীদের প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে সাহাবউদ্দীন বলেন, নিজের উদ্ভাবিত ডিভাইস নিয়ে ব্যবসায় নেমেছি। ডিভাইস বাজারজাত করার জন্য উত্তরা মোটর্সের চেয়ারম্যান সুযোগ করে দিয়েছেন। এটিএস লক ডিভাইস এখন উত্তরা মোটর্সের নামেই সারাদেশের নিজস্ব সব শোরুমে পাওয়া যাচ্ছে। দাম নির্ধারণ করা হয়েছে দুই হাজার টাকা।
এদিকে সাহাবউদ্দীনের ‘এটিএস’ এবং ‘এসটিপি’ ব্যবহার সম্প্রতি পর্যবেক্ষণ করে মেহেরপুর পুলিশ সুপার আনিছুর রহমান সন্তোষ প্রকাশ করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মোটর সাইকেল মানুষের শখ ও অতি প্রয়োজনীয় বাহন। তাই এর চুরি নিয়ে চিন্তা থাকে। চুরি প্রতিরোধে ‘এটিএস’ সিস্টেম সময়োপযোগী উদ্ভাবন। মোটর সাইকেলে ‘এটিএস’ স্থাপনের বিষয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা করা হচ্ছে।
‘এটিএস’ ব্যবহারের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে সাহাবউদ্দীন বলেন, মোটর সাইকেলের জন্য বাজারে প্রচলিত লকে প্রচুর ব্যাটারি চার্জ ফুরায়। ব্যাটারি দুর্বল হয়ে পড়ে। কিন্তু এটিএস’র পাওয়ার ব্যাটারি থেকে দেয়া হয়নি। তাই স্টার্ট লাইন অফ থাকলে ব্যাটারি চার্জ ফুরায় না।
লক উদ্ভাবনের পাশাপাশি আরেকটি ডিভাইস আবিষ্কার করেছেন সাহাব উদ্দীন। যার নাম দিয়েছেন ‘এসটিপি’। বর্তমান সময়ে বাজাজ মোটর সাইকেলসহ বিভিন্ন প্রকার মোটর সাইকেল আন্তর্জাতিকভাবে অনলাইনে মার্কেটিং হচ্ছে। মোটর সাইকেল স্টার্ট করলেই হেডলাইট জ্বলে থাকে। যা আমাদের দেশের প্রচলিত সিস্টেমের সঙ্গে একেবারেই বেমানান।
সাহাবউদ্দিনের উদ্ভাবিত ‘এসটিপি’ ডিভাইস দিয়ে হেডলাইট চালু ও বন্ধ করা যায়। এছাড়াও একটিমাত্র সুইচের মাধ্যমে ডান-বামের ইন্ডিকেটর জ্বালানো এবং একইসঙ্গে ৪টি ইন্ডিকেটর জ্বালানো সম্ভব। এই ডিভাইসটিও সারাদেশে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। মেহেরপুর জেলার অনেক মোটর সাইকেল মালিক ‘এটিএস’ স্থাপন করেছেন। তাই এখন মোটর সাইকেল চুরি নিয়ে আর কোনো ভাবনা নেই বলে জানালেন ব্যবহারকারী কয়েকজন। যেখানে-সেখানে মোটর সাইকেল রেখে দুঃশ্চিন্তা ছাড়াই কাজ করতে পারছেন মালিকরা। [সুত্রঃ আরটিভি]