ছুটির দিনে সময় করে বেড়িয়ে আসতে পারেন মোগল স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন ঢাকার লালবাগ কেল্লা থেকে। কর্মব্যস্ত শহরে ছুটির দিনে ঘোরার জন্য এরচেয়ে ভালো জায়গা যেন আর হয়না। মোগল আমলে নির্মিত মনোরম ও আকর্ষণীয় প্রাসাদ ছাড়াও এখানে রয়েছে বাংলাদেশের একটি দুর্লভ স্থা্পত্য কীর্তি পরীবিবির মাজার। মাজারের চারদিকে রয়েছে তিনটি করে দরজা।
মাজারটি নির্মাণে ঘটানো হয়েছে মুসলিম ও হিন্দু ধর্মীয় স্থাপত্যের এক অপরূপ সংমিশ্রণ। মাজারটির জন্য সংগৃহীত হয়েছিল উত্তর ভারতের রাজমহল থেকে কালোপাথর, চুনার থেকে বেলেপাথর ও জয়পুর থেকে সাদা মার্বেল পাথর। পাথরের প্রান্তগুলো খোদাই করা ও ফুল-পাতায় অলংকৃত।
নির্মাণ ইতিহাস
প্রাথমিকভাবে কেল্লার নাম ছিল কেল্লা আওরঙ্গবাদ। কেল্লাটির নকশা করেন শাহ আজম। মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব-এর ৩য় পুত্র আজম শাহ ১৬৭৮ খ্রিস্টাব্দে ঢাকার সুবেদারের বাসস্থান হিসেবে এ দুর্গের নির্মাণ কাজ শুরু করেন। তবে মাত্র এক বছর পরেই এবং দুর্গের নির্মাণকাজ শেষ হবার আগেই মারাঠা বিদ্রোহ দমনের জন্য সম্রাট আওরঙগজেব তাকে দিল্লিতে ডেকে পাঠান। এসময় একটি মসজিদ ও দরবার হল নির্মাণের পর থেমে যায় দুর্গ নির্মাণের কাজ। পরবর্তীতে নবাব শায়েস্তা খাঁ ১৬৮০ সালে ঢাকায় এসে পুনরায় দুর্গের নির্মাণকাজ শুরু করেন। তবে শায়েস্তা খানের কন্যা পরী বিবির মৃত্যুর পর এ দুর্গকে অপয়া মনে করা হয় এবং শায়েস্তা খান ১৬৮৪ খ্রিস্টাব্দে বন্ধ করে দেন এর নির্মাণ কাজ।
পরী বিবির সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছিল শাহজাদা আজম শাহের। পরী বিবির মৃতুর পর তাকে সমাহিত করা হয় দরবার হল এবং মসজিদের ঠিক মাঝখানে। শায়েস্তা খাঁ দরবার হলে বসে রাজকাজ পরিচালনা করতেন। ১৬৮৮ সালে শায়েস্তা খাঁ অবসর নিয়ে আগ্রা চলে যান। শায়েস্তা খাঁ ঢাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার পর নানা কারণে লালবাগ দুর্গের গুরুত্ব কমতে থাকে।
পরবর্তীতে ১৮৪৪ সালে “ঢাকা কমিটি” নামে একটি আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠান দুর্গের উন্নয়ন কাজ শুরু করে। এ সময় দুর্গটি লালবাগ দুর্গ নামে পরিচিতি লাভ করে।
১৯১০ সালে লালবাগ দুর্গের প্রাচীর “সংরক্ষিত স্থাপত্য” হিসেবে আনা হয় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধীনে। অবশেষে নির্মাণের ৩০০ বছর পর গত শতকের আশির দশকে লালবাগ দুর্গের যথাসম্ভব সংস্কার করে এর আগের রূপ ফিরিয়ে আনা হয় এবং দর্শনার্থীদের জন্য করা হয় উন্মুক্ত।
যা দেখতে পাবেন
কেল্লার অভ্যন্তরে রয়েছে একটি হাম্মামখানা বা গোসলখানা, দরবার হল, মাটির প্লাটফরম, ঝর্ণা, জলাধারা, তিন গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদ। মসজিদের ছাদে তিনটি গম্বুজের গোড়ার অংশ অষ্টকোণাকৃতি ড্রামের আকারের এবং তা পাতার নকশায় অলংকৃত। এছাড়াও রয়েছে পাড় বাঁধানো একটি পুকুর ও প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের নির্মিত জাদুঘর।
কেল্লার উত্তর-দক্ষিণে অবস্থিত প্রধান ফটক, উত্তর তোরণ, পশ্চিম তোরণ ও তিনতলাবিশিষ্ট আকর্ষণীয় স্থাপত্য নিদর্শন হচ্ছে দক্ষিণ তোরণ। দরবার হলকে রূপান্তরিত করা হয়েছে জাদুঘর হিসেবে। জাদুঘরে রয়েছে মোগল আমলের অস্ত্রশস্ত্র,পান্ডুলিপি, মুদ্রা, মৃৎশিল্প, কার্পেট, চিত্র, হস্তলিপি ও রাজকীয় ফরমান।
দর্শনার্থী ও প্রবেশ ফি
দর্শনার্থীর সমাগম যেন দিন দিন বেড়েই চলেছে মোগল আমলের অন্যতম স্থাপত্য নিদর্শন ঢাকার লালবাগ কেল্লায়। ইতিহাসের সাক্ষী এ কেল্লা প্রতিদিনই হাজার হাজার দর্শনার্থীর পদচারণায় মুখরিত। কর্তৃপক্ষের হিসেব অনুযায়ী, প্রতিবছর এখানে গড়ে প্রায় ৩০ লাখ দেশি-বিদেশি দর্শনার্থীর সমাগম ঘটে। আর প্রতিদিন লালবাগ কেল্লা দেখতে আসে দেশি-বিদেশি প্রায় ১০ হাজার দর্শনার্থী। এর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও সাধারণ দর্শনার্থী। বিদেশি দর্শনার্থীরা এখানে আসেন কেল্লার ইতিহাস জানতে।
সাধারণ দর্শনার্থীদের জন্য প্রবেশ ফি ১০ টাকা এবং বিদেশি দর্শনার্থীদের জন্য ১০০ টাকা। বার্ষিক টিকিট বিক্রির আয় সাড়ে ৩ কোটি টাকা ।
লালবাগ কেল্লার সময়সূচী
রোববার ব্যতীত প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকে কেল্লা।
গ্রীষ্মকালীন (এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর) সময়সূচি — সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত। আর শীতকালীন (অক্টোবর থেকে মার্চ) সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা।
এর মাঝে রয়েছে ১টা থেকে ত্রিশ মিনিটের মধ্যাহ্ন বিরতি। তবে শুক্রবারে মধ্যাহ্ন বিরতি থাকে ১২টা ৩০ মিনিট থেকে ২টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত।
রোববার পূর্ণ দিবস, সোমবার অর্ধ দিবস এবং সব সরকারি ছুটির দিনগুলোতে লালবাগ দুর্গ বন্ধ থাকে।