ময়মনসিংহ শহরে অবস্থিত একটি ঊনবিংশ শতকীয় প্রাসাদ আলেকজান্দ্রা ক্যাসল। এই প্রসাদটি ১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দে স্থাপিত ময়মনসিংহ জেলার প্রতিষ্ঠা শতবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে মহারাজা সুকান্ত সুর্যকান্ত আচার্য চৌধুরী নির্মাণ করেছিলেন। প্রাসাদটি ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত হয়। নির্মাণকালে প্রাসাদটির জন্য ব্যয় হয়েছিল ৪৫ হাজার টাকা। ভবন নির্মাণে লৌহের ব্যবহারের কারণে জনসাধারণ্যে এটি ‘লোহার কুঠি’ নামেও পরিচিত ছিল। বর্তমানে এটি ব্যবহৃত হচ্ছে শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজের গ্রন্থাগার হিসাবে। ৭০ বছর ধরে ঐতিহাসিক এ স্থাপনাটি ময়মনসিংহ টিচার্স ট্রেনিং কলেজ তাদের বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করে আসছে।
আলেকজান্দ্রা ক্যাসল ময়মনসিংহ শহরের প্রাচীন স্থাপনাসমূহের মধ্যে অন্যতম। শহরের কেন্দ্রস্থরে কোর্ট-কাঁচারীর কাছে এটির অবস্থান। বহু বরেণ্য ব্যক্তি এই প্রসাদে অবস্থান করেছেন। ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ময়মনসিংহ সফরকালে আলেকজান্দ্রা ক্যাসলে চার দিন অবস্থান করেছিলেন। একই বছর মহাত্মা গান্ধীও এসেছিলেন এখানে। এখানে আরো পদার্পণ করেছিলেন লর্ড কার্জন, চিত্তরঞ্জন দাশ, নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহ, কামাল পাশা, মৌলভী ওয়াজেদ আলী খান পন্নী, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু প্রমুখ।
স্থানীয় বাসিন্দা ও টিচার্স ট্রেনিং কলেজের শিক্ষকগণ জানান, ঐতিহাসিক এ ভবনটি বর্তমানে টিচার্স ট্রেনিং কলেজের গ্রন্থাগার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। চারদিকে সীমানাপ্রাচীর না থাকায় ভবনটি অনেকটা অরক্ষিত। কলেজ কর্তৃপক্ষের নজরদারির অভাবে দিনে ও রাতে মানুষজন অবাধে ভবনের বিভিন্ন স্থানে আনাগোনা করে। এতে অনেকটাই হুমকির মুখে পড়েছে স্থাপনাটি।
নির্মাণের পর নানা রাজকীয় আসবাবে সুসজ্জিত করা হয়েছিল ভবনটি। এছাড়াও ভবন চত্বরে রয়েছে দীঘি ও বাগান।
ময়মনসিংহ জেলার ইতিহাস ও টিচার্স ট্রেনিং কলেজ সূত্রে জানা যায়, মুক্তাগাছার জমিদার মহারাজা সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরী শহরের জুবিলি উৎসব পালনের জন্য তৎকালীন ভারত সম্রাট সপ্তম এডওয়ার্ড পত্নী আলেকজান্দ্রার নামে দ্বিতল এ ভবনটি নির্মাণ করেন। মতান্তরে ময়মনসিংহের তৎকালীন ইংরেজ কালেক্টর আলেকজান্ডার আইসিএসের নামে ১৮৭৯ সালে এটি নির্মিত হয়। ভবনটি মহারাজা সূর্যকান্ত আচার্যের বাগানবাড়ি হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এ ভবন ঘিরে ১৯৪৮ সালে ২৭ দশমিক ১৫ একর জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হয় টিচার্স ট্রেনিং কলেজ। শুরুতে আলেকজান্ডার বা আলেকজান্দ্রা ক্যাসেলটি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের শ্রেণিকক্ষ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। পরবর্তী সময়ে কলেজের ভবন বৃদ্ধি পেলে ক্যাসেলের দোতলায় শিক্ষকেরা বসবাস শুরু করেন। এরপর দীর্ঘদিন ধরে ভবনটি কলেজের গ্রন্থাগার হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। নিচতলার আটটি কক্ষ কলেজের গ্রন্থাগার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এতে প্রায় ১৫ হাজার বই রয়েছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, ভবনের চারদিকে কোনো সীমানাপ্রাচীর নেই। ভবনের বারান্দা ও আশপাশে কলেজের পক্ষ থেকে বহিরাগত মানুষকে বসতে নিষেধ করা হলেও তা মানা হচ্ছে না। দিনের বিভিন্ন সময়ে নানা বয়সী লোক ভবনের বারান্দায় বসে আড্ডা দেন। টিচার্স ট্রেনিং কলেজের সঙ্গে অবস্থিত ময়মনসিংহ গভ. ল্যাবরেটরি স্কুল। ওই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের অভিভাবকেরা বেশির ভাগ সময়ই ক্যাসেলের বারান্দায় বসে সময় কাটান। সম্প্রতি মানুষের অবাধ যাতায়াত নিয়ন্ত্রণে ক্যাসেলের একাংশে কাঁটাতারের বেষ্টনী দেওয়া হয়। কিন্তু অন্য অংশে কোনো প্রাচীর নেই।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ২০১৫ সালের ৪ এপ্রিল ময়মনসিংহের আরেক ঐতিহাসিক স্থাপনা মহারাজ শশীকান্তের নামে নামকরণ করা শশীলজটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর নিজেদের অধীনে নিয়ে যায়। ওই ভবনটি ময়মনসিংহের মহিলা টিচার্স কলেজের প্রশাসনিক ভবন হিসেবে ব্যবহার করা হতো। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর শশীলজটি প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর হিসেবে প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে কাজ শুরু করেছে।
টিচার্স ট্রেনিং কলেজ সূত্র জানায়, বর্তমানে কলেজটিতে তিনতলাবিশিষ্ট তিনটি ভবন রয়েছে। এরপর আরও ভবন তৈরির জন্য রয়েছে পর্যাপ্ত স্থান। এ ক্ষেত্রে সরকারের কোনো বিভাগ যদি কলেজের জন্য একটি গ্রন্থাগার ভবন নির্মাণ করে দেয়, তাহলে আলেকজান্দ্রা ক্যাসেলটি কলেজ কর্তৃপক্ষ ছেড়ে দিতে আপত্তি করবে না।
কলেজের অধ্যক্ষ মো. রেজাউল করিম বলেন, ‘আমরা ক্যাসেলে বহিরাগতদের অবাধ যাতায়াত নিয়ন্ত্রণের জন্য সম্প্রতি একজন আনসার সদস্য নিয়োগ করেছি। বহিরাগতদের যাতায়াত নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছি। ভবনের কোনো অংশে বসে থাকতে দেখলে তাঁদের সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।’
গ্রন্থাগারের বিষয়ে কলেজ অধ্যক্ষ জানান, ‘পৃথক ভবন নির্মাণ করে দেওয়া হলে ক্যাসেলটি ছেড়ে দিতে আমাদের কোনো আপত্তি থাকবে না।’
ময়মনসিংহ প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘরের সহকারী জিম্মাদার সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, ‘প্রায় আট মাস আগে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর থেকে একটি দল এসে আলেকজান্দ্রা ক্যাসেলটি পরিদর্শন করেছে। তবে তাদের কী সিদ্ধান্ত, সেটি আমার জানা নেই।’